প্রথম পর্ব
রণ( ১)
পেভমেনট এ বসে আছি পা ঝুলিয়ে। আমার পাসে বসা বিশ্বের
সবচেয়ে অদ্ভুত মেয়ে। কিছুক্ষণ পর পর হাওয়ায় মেয়েটির সিল্কি চুল আমার মুখ ছুঁয়ে
যাচ্ছে ।আমি একদৃষ্টে ঘাড় ঘুরিয়ে ওকে দেখছি।
সে মনের আনন্দে নিজের মুখের কিম্ভূত সব ভঙ্গী করে একের পর এক ছবি তুলে যাচ্ছে আমার
মোবাইল ক্যামেরায় । আচ্ছা , ওকি ভুলে গেছে যে আমি একটা জলজ্যান্ত মানুষ ওর পাশে
বসে আছি?
মেয়েটা আমার ছোট বেলার বান্ধবী তিয়া।
বিদেশে থাকে। আজ এত বছর পর দেশে ঘুরতে এসেছে । কত বছর দেখা সাক্ষাত নেই। তবে অনলাইন এ
আমাদের প্রচুর কথা বার্তা হত । অপরিচিত নাম্বার থেকে কল টা এলো
আজ সকালে ... ওপাশ সুরেলা গলার আওয়াজ ...
ঘুণাক্ষরে ভাবতে পারিনি যে তিয়া হতে পারে।
সাদা টি শার্ট এর উপর কালো শ্রাগ ,আর নীল ডেনিমের স্কিনি জিন্স, পিঠ খোলা অসম্ভব সুন্দর মখমলের
মত চুল,পায়ে হাল ফ্যাশান এর ব্যালেরিনা জুতো (মেয়েদের পোশাক আশাক এর ব্যাপারে আমি
ক অক্ষর গোমাংস ,নাম টা সদ্য আমার সাধারণ জ্ঞান
এ এন্ট্রি পেয়েছে,তিয়ার সুবাদে)। পুরাদস্তুর ভিন গ্রহ থেকে উড়ে আসা মেয়েটা আশেপাশে মোটামুটি চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করে দিয়েছে। ছেলে মেয়ে নির্বিশেষে সবাই আমাদের ঘুরে ঘুরে দেখে যাচ্ছে । আ ...মানে, আসলে ওকে দেখছে। তিয়া নির্বিকার ।
আমিও তিয়া কে নকল করে নির্বিকার হবার চেষ্টা করতে লাগলাম ।
কিন্তু ওর গোলাপের পাপড়ির মত ঠোঁট
দুটোই হল আমার কাল। আমার চেষ্টার নিরানব্বই শতাংশ ধূলিসাৎ করে দিচ্ছে ক্রমাগত।মাঝে
মাঝেই ঝকঝকে সাদা দাঁত দিয়ে নিচের ঠোঁট টা কে অন্যমনস্ক ভাবে কামড়ে ধরছে। নিজেকে ভাল ছেলে বলে জানতাম ।
এখন মনে হচ্ছে, ভাল ছেলের ট্যাগ টা হয়ত ত্যাগ করার সময় এসে গেছে। কি ভাবছে
ও?
এই সব রাজ্যের আগডুম বাগডুম ভাবছি তক্ষুনি মহারানীর কৃপাদৃষ্টি আমার উপর পড়ল
।
-“ এই , বিয়ার আনাবে বলছিলি , কোথায়?”
তিয়া(১)
মিষ্টি হাওয়ায় মন জুড়িয়ে যাবার কথা।
কিন্তু কি যে হয়েছে । রণর সাথে দেখা হবার
সেকেন্ড থেকেই সবকিছু কেমন জানি তালগোল পাকিয়ে গেল। এমনটি আশা করিনি। পুরনো বন্ধুর
সাথে হৈ হুল্লোড় , পাগলামো , শয়তানী...
অনেক প্ল্যান নিয়েই দেখা করতে গিয়েছিলাম । অন লাইন এ ঠিক করা ছিল, আমি এলে ও আমায়
বিয়ার খাওয়াবে। বেচারা , স্বপ্নেও ভাবেনি আমি
বিদেশ থেকে উড়ে আসব কখনো । কপাল
খারাপ। আমি এসেছি এবং এসেই ফোন করে প্রথম কথা বলেছি বিয়ার জোগাড় করতে। বিয়ার শুনে
আকাশ থেকে পরেছিল রণ । না, আমি মেয়ে হয়ে বিয়ার খাই শুনে না। বেচারা কোথা থেকে বিয়ার আনবে তাই ভেবেই আকুল। অন লাইন এ, প্রচুর বাঘ
ভাল্লুক মেরেছে বাছাধন । ওর মত cool dude নাকি খুঁজলে পাওয়া যাবে না। হু
হু ... আমার নাম অ তিয়া। আমার মত
নাছোড়বান্দা পাবলিক খুব কম ঈ দুনিয়া তে আছে। আমার সাথে এটিচুড? বিয়ার আমি পছন্দ করি না। কিন্তু cool রণ কে কুল
কুল করে ঘামাতে দেখে হেসে কুটি পাটি হচ্ছিলাম ফোন এর এপাশ থেকে। অবশেষে রণ রণে
ভঙ্গ দিয়ে আত্ম সমর্পণ করল।
যদিও আমার আনন্দ খুবই ক্ষণস্থায়ী হল। খুশি মনেই দেখা করতে
গিয়েছিলাম। এখন আফসোস হচ্ছে। প্রচণ্ড আফসোস।
স্বচ্ছ সাদা ফুলহাতা শার্ট এর নিচে শক্ত , মেদ হীন সুঠাম অবয়ব। শার্ট এর হাতা রোল করে কনুই এর উপর
গোটানো ...পেশীবহুল হাত ।একমাথা ঝাঁকড়া
কোঁকড়ানো চুল । আর, আর... অসম্ভব সুন্দর দুটো চোখ
।এত সুন্দর ... এখন হয়েছে না আগেই
ছিল? মনে করতে পারছিনা। কখনো ওকে সেভাবে দেখা হয়ে ওঠেনি । আজ যখন স্লাইডিঙ দরজা দিয়ে কফি শপ এ পা দিল আমি সিট এ জমে
গিয়েছিলাম। তারপর সোজা এখানে।
আমি ওর মোবাইল এ ছবি তোলায় ব্যস্ততার
বাহানা বানাচ্ছি গত আধাঘণ্টা ধরে।বুঝতে পারছি আমার উপর একজোড়া চোখ নিবদ্ধ। কিন্তু আমি তাকাব না। রবিঠাকুরের কবিতার
মর্মার্থ আজ প্রথমবার উপলব্ধি হল ।
“সেদিন চৈত্র মাস
তোমার চোখে দেখেছিলাম আমার সর্বনাশ”
রণ(২)
ক্রিং ক্রিং ক্রিং ক্রিং...
আমার বিদঘুটে রিংটোনে ফোন বেজে উঠলো
। স্ক্রিন এ নাম টা পরতেই মনে হল কেউ যেন আমায় স্বপ্নের জগত থেকে হ্যাঁচকা টেনে
ছিঁড়ে বাস্তবে ছুড়ে মেরেছে । নাতাশা। সর্বনাশ ! দু সেকনড এর জন্য মনে হল আমার হৃদপিণ্ড গলায় আটকে গেছে।
ফোন টা হাত থেকে পরতে পরতে বেঁচে গেল। তিয়া আমার অস্বাভাবিক পরিবর্তন এ অবাক।
-ফোন টা কি তুলবি ?
-না, ঠিক আছে, পরে কথা বলে নেব।
-কার ফোন ?
কি বলবো আমি ওকে ? বলব কি , নাতাশা,
আমার গার্লফ্রেন্ড, যার কথা বেমালুম ভুলে গিয়ে আমি কিছুক্ষণ আগে তোর ঠোঁটে ডুবে
যাবার স্বপ্ন দেখছিলাম?
ফোন টা কেটে দিলাম। তিয়া আমায় চোখ সরু
করে দেখতে লাগলো ।
ক্রিং ক্রিং ক্রিং ক্রিং...
শিট । আবার নাতাশা।
-ফোন টা তুলে নে এবার । ইম্পরট্যান্ট
হতে পারে।
আমি একবার তিয়ার দিকে, আরেকবার ফোনটার
দিকে তাকালাম। নাহ, এবার না তুললে কেলেঙ্কারি হতে পারে।
-হ্যালো
-কোথায় তুমি? ফোন তুলছিলে না যে? তিয়ার সাথে দেখা হল?
-ইয়েস, ওর সাথেই আছি ।
-ইশসস, তুমি খুব দুষ্টু, তিয়ার সাথে আমার দেখা করালে না।
-সরি, কিন্তু, টেনশন নট । দেখা অবশ্যই
করাব। এখন রাখি সোনা ?
-হুম। রাখো ,পরে কল করো । টা টা ।
তিয়ার মুখের মানচিত্র বদলে গেছে। যদিও
আমার মোটা বুদ্ধি তে কুলালও না যে কোন অ্যাঙ্গেল এ বদলেছে।
-এতবছর ধরে কথা বলছিস, গার্ল ফ্রেন্ড
আছে বলিসনি যে?
- না... মানে... আসলে ...প্রেমটা ...
আমি...
-তোলাচ্ছিস কেন? এত গুড নিউজ হাঁদারাম
।
বলেই অদ্ভুত একটা হাসি দিল তিয়া।
হাসিটা এতটাই রহস্য ময় যে, ভাবনা চিন্তা সব গুবলেট হয়ে গেল।
-বল এবার, দেখা কবে করাচ্ছিস?
-উম ম... এখন দেখা করতে চাস ?
-আরিবাবা, প্রেমিকার বিরহে দেকছি একদম
টাসকি খেয়ে গেছিস।
- না মানে, দেখা করবি তো এখুনি করাতে
পারি, নাতাশাও চাইছিল ।
প্লীজ প্লীজ , হ্যাঁ বলিস না তিয়া—মনে
মনে বললাম। কি যে হয়েছে আমার। গার্ল ফ্রেন্ড ডাকছে , তাকে পাত্তা না দিয়ে আমি এই
যানা অজানা মেয়েটার সাথে থাকতে চাইছি । নিজে কে খুব ছোটো মনে হল।
আমার ভাবনার ঝড় কে চুরমার করে তিয়া
বলে উঠলো ... “চল”
শিট ।
তিয়া (২)
রণর গার্ল ফ্রেন্ড আছে? থাকতেই পারে।
ঋত্বিক রউশান এর মত যে ছেলে দেখতে তার
পেছনে মেয়েদের ঢল নামবে না, তার গার্ল ফ্রেন্ড থাকবে না, কি করে ভাবলাম আমি? আমি আসলে
সত্যি বলতে ভাবছিলাম টা কি?
ওর মুখে খবর টা শুনে এক মুহূর্তের
জন্য মনে হয়েছিল আমার চার পাশের পৃথিবীটা স্তব্ধ হয়ে গেছে। বুকের রক্ত চলকে উঠেছিলো । কিন্তু আমার এমন কেন লাগছে? ছি তিয়া,
রণ না তোর বন্ধু? এ কি সব পাগলের মত ভাবছি আমি?
আমার তো খুব খুশী হওয়া উচিত। তবুও
এত আনন্দের ব্যাপারটা তে সহজে আনন্দিত হতে পারলাম না।
এখন আমি চলেছি রণর গার্ল ফ্রেন্ড
দেখতে। হাসি পেল। মনে হচ্ছে চিড়িয়াখানা ঘুরতে
যাচ্ছি । নতুন প্রাণী এসেছে । কেমন হবে ওর প্রেমিকা?
তিনটে কফি লাটের অর্ডার
দিয়ে বসে আছি এমন সময় নাতাশার আবির্ভাব । ওহ মাই গড । এতো আগুন !!!
গমের মত গায়ের রঙ, কোমর পর্যন্তও হাল্কা ঢেউ খেলানো চুল,
ছিপছিপে সাড়ে পাঁচ ফুটের একটা মেয়ে বিশাল একটা হাসি নিয়ে আমাদের টেবিল এর দিকে
এগিয়ে এলো। আমার মুখ মনে হয় ঝুলে পরেছিল, কারণ নাতাশা এসেই আমার চিবুক এ এক আঙুল
ছুঁয়ে বলল, “তিয়া, অত বড় হা করলে যে মাছি ছাড়ও , ঘাস ফড়িং পর্যন্ত ঢুকে যেতে
পারে”। বলেই আরেকটা বিশাল হাসি ।
মিথ্যে বলব না। এত সুন্দরী মেয়ে এত
সাধারণ একটা কফি সপ এ কখনো দেখব আশা
করিনি।
-হাই নাতাশা। অবশেষে ভাষা খুঁজে পেলাম।
- তিয়া, কি যে খুশি লাগছে তোমায়
দেখে কি বলব। রণ তোমাদের শৈশব এর গল্প করতে
করতে নস্টালজিক হয়ে যেত । তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে ওর শৈশব এর একটা টুকরো আমার চোখের সামনে ভেসে উঠলো
। অনেক ধন্যবাদ আসার জন্য এবং আমার সাথে দেখা করার জন্য। তবে একটা কথা না বললেই নয় তমায় , রণ যেভাবে তোমার গল্প
করে, কখনো কখনো ত সন্দেহ হয়, তুমিই
ওর গার্ল ফ্রেন্ড , আমি না , ।
বলেই খিলখিলিয়ে হেসে উঠলো নাতাশা নামের জল পরী । আমি চমকে উঠলাম
।
দ্বিতীয় পর্ব
রণ (৩)
নাতাশা কে গাড়িতে তুলে দিলাম। এমনিতে আমিই
বাসায় ছেড়ে আসি । আজ ও মানা করল। বলল তিয়া আপু
এখানে নতুন, কিচ্ছু চেনে না , তিয়া আপু কেই বাসায় পৌঁছে দিতে। সাধারণত আমি থাকলে নাতাশা কে
একা বাসায় ফিরতে দেবার চিন্তা করাও আমার জন্য অস্বস্তিকর । আজ, আমি যেন খুশিই হলাম
না যেতে পেরে ওর সাথে। উফফ, কি যে হয়েছে আজ।
তিয়া দেখলাম অস্বাভাবিক রকম নীরব । হল
তা কি? সন্ধ্যার আবছা আলো ছায়ায় ওর মুখের কোনও রেখাই পড়তে পারছিলাম না।
-তিয়া, এখন যাবি না আরও কিছুক্ষণ থাকবি ?
খুব ইচ্ছে করছিলো ওকে কাছে টেনে ওর
চোখে চোখ রাখতে। মনে মনে নিজেকে বকা শুরু
করলাম।হচ্ছে টা কি রণ? ছিঃ ,তুই না নাতাশা কে ভালবাসিস ? নাতাশা আমায় পাগলের মত
ভালবাসে । আমিও বাসি ...মানে অন্তত আজ সকালে আমার
পাশে দাঁড়ানো মেয়েটার মুখোমুখি হবার আগের মুহূর্ত পর্যন্ত তাই জানতাম।
কিন্তু একি অমোঘ আকর্ষণে তিয়ার দিকে মন
ছুটে চলেছে । হৃদয়ে যে ঝড় উঠেছে তার পরিণতি কক্ষনো ভাল হতে পারে না।
ভাবনায় ছেদ পড়লো তিয়ার ডাকে ।
-আমায় ছেড়ে আসবি না?
-চল।
দুজনে নীরবে হাঁটছি । তিয়া অস্বাভাবিক
রকম নীরব । ঘাড় নিচু করে হেঁটে যাচ্ছে । মেয়েদের নীরবতা ব্যাপার টা আমার কাছে অশনি সংকেত এর মত । আমার আবার মনে হল, তিয়া হয়ত
ভুলেই গেছে যে ওর পাশে আরেকটি জীবন্ত মানুষ বর্তমান । আমি দাঁড়িয়ে পড়লাম । তিয়া
এগিয়ে চলল। আমি ডাকতে চাইলাম ওকে পেছন থেকে। পারলাম না। আমি যেন বোবা হয়ে গিয়েছি । নিজের সমগ্র শক্তি কে আহবান
করে অবশেষে ডাকলাম আমি...
-তিয়া......
তিয়া(৩)
রন কে দেখলাম । রনর প্রেমিকা কে
দেখলাম। নিজেকে দেখলাম। কষে চড় মারতে ইচ্ছে করল নিজেকে। আমি এখনো কি করে দাড়িয়ে
আছি? দৌড়ে পালাচ্ছি না কেন ? রনর নাতাশা। নাতাশার রণ । আমি কে এখানে? আমি কালকেই
চলে যাব দেশ ছেড়ে । সব কিছু অসহ্য লাগছে। কেন এসেছিলাম আমি এখানে? কেন দেখা করতে
চাইলাম?
-তিয়া..............................
আমার ভাবনার নিকষ কালো অন্ধকার গহ্বর থেকে যেন টেনে তুলল রণর স্বর । রন
আমার পাশে নেই। ঝটতি ঘাড় ঘোরাতেই ও আর আমি একে অপরের দিকে। মাঝখানে মনে হল
অন্তহীন দূরত্ব । রণর চেহারা ফ্যাকাসে । ওর চোখের দিকে তাকাতেই
আমি স্থির। সে চোখের ভাষা আমায় এক অদৃশ্য
সুতোয় বেঁধে ফেলেছে। আমার অজান্তেই সুতোর টানে আমার পা দুটি ওর দিকে এগিয়ে চলল।
মুখোমুখি আমরা দুজন। আমার চিন্তা
ভাবনা স্থবির । সময় যেন থেমে গেছে আমাদের
ঘিরে। আমি সমগ্র ইন্দ্রয় কেন্দ্রীভূত প্রবল গতি তে
এগিয়ে চলা আমার দুর্বল
হৃদপিণ্ডের অস্তিত্বে ।
-তিয়া...।
ব্যস । রনর ফ্যাসফেশে আওয়াজে ওই একটি শব্দে আমার সকল বাঁধ ভেঙে নিঃশেষ হয়ে গেল এক লহমায়।
আমি পারলাম না আর নিজেকে ধরে রাখতে। হাঁটু ভেঙ্গে পরে গেলাম , মনে হল পায়ের নিচ থেকে যেন মাটি
সরে গেছে । আমি দুহাতে মুখ ঢেকে
ঝরঝর করে কেঁদে ফেললাম
“তিয়া, তিয়া, কি হয়েছে? প্লীজ তিয়া,
কি হয়েছে বল,”
রনর আতঙ্কিত দিশেহারা কণ্ঠস্বরে আমার কান্নার বেগ আরও প্রবল
হল। কাছে টেনে নিল ও । আমি চাই ওর বুকে মুখ লুকিয়ে কাঁদতে । আমি চাই ওর ঠোঁটে আমার
চোখের জল মুছে নিতে। আমি চাই ওর ওই বলিষ্ঠ বাহুবন্ধনে আবদ্ধ হতে, আমি চাই আমার
প্রতিটি নিঃশ্বাসে ওর স্পর্শ পেতে। আমি ওকে আঁকড়ে ধরতে চাই ...কিন্তু আমি এসবের কিছুই করলাম না।
রন (৪)
আমি তিয়ার থেকে একহাত দূরে ছিটকে পরে
আছি এবং তিয়ার কান্না এখনও থামেনি। কেন করল
ও এমন ? তিয়াকে কাছে টেনে নিতেই তিয়া নিজের সর্বশক্তি দিয়ে আমায় ধাক্কা মেরেছে।
আমি কিছুই বুঝতে পারছিনা। আমি উঠে আরেকবার তিয়ার কাছে যাবার চেষ্টা করতেই ও আমায় হাত তুলে থামাল।
“ তিয়া, আমি কিছুই বুঝছিনা। আমি কি
দোষ করেছি? এমন কেন করছিস?”
তিয়া জলভরা চোখ তুলে তাকাল আমার দিকে।
বিকারগ্রস্ত মানুষের চোখ । জীবনে প্রথমবার আমি ভয় পেলাম।
“ রণ, পরের মাসে আমার এনগেজমেনট , আমার বয় ফ্রেন্ড এর সাথে”
আমি এখন চলতশক্তিহীন
একটা জড় পদার্থ । কি?????????? তিয়ার বয়ফ্রেন্ড ? এনগেজমেনট? কবে, কিকরে?
“ আমি তোকে দেখা করে মুখোমুখি বসে এই
খবর টা দিয়ে সারপ্রাইজ দিতে ছেয়েছিলাম।
কিন্তু কিন্তু......”
আমার সব কিছু অবিশাস্য লাগছে। তিয়া আরও অনেক কিছু বলতে গিয়েও চুপ করে
গেল। তাকালাম আমরা এক দুজনের দিকে। কেন এমন লাগছে আমার? তিয়ার প্রেমিক তো থাকতেই
পারে। যেমন আমার নাতাশা। তবে কেন তিয়া কাঁদছে? কেনইবা তিয়ার প্রেমিকের কথাটা কানে গরম সীসা ঢেলে দেওয়ার মত লাগলো? আমি কি
পাগল হয়ে যাচ্ছি? উত্তর চাই আমার। আমি এগিয়ে গেলাম ওর দিকে, তিয়া মাথা ঝাঁকিয়ে
আমায় কাছে আসতে বারণ করছে। আমার এখন কোনও কিছুতেই যায় আসে না। ওর মুখটা নিজের দু হাতে
নিয়ে চোখে চোখ রাখতেই হটাৎ করে যেন
সবকিছু স্বচ্ছ পানির মত পরিষ্কার হয়ে গেল।
তিয়া ... তিয়া... আমায় ভালবাসে ... যেমন বাসি আমি ওকে ।
তিয়া (৪)
খোলা জানালা দিয়ে দূরে ওঠা ঝড় দেখছি
আমি। খুব আপন মনে হচ্ছে ঝড় টা কে। সেদিন রনর চোখে নিজের মনের অজানা অনুভুতিগুল যখন নগ্ন
হয়ে দাঁড়ালো , মুখ লোকাতে ওকে পেছনে ফেলে পালিয়ে এসেছিলাম । খুব ছোট লাগছে নিজেকে।
আমার এক বছরের প্রেম রিয়াজ । ভাল ছেলে বলতে যা বোঝায় রিয়াজ এক কোথায় সেই নিখুঁত ছেলেদের দলের অন্তর্গত ।
সৎ , নিষ্ঠাবান , সফল , এবং আরও যা যা গুণ
একটা ছেলেকে অনেক মেয়েরই আরাধ্য করে তোলে তা সবই নিয়ে রিয়াজ। খুব ভাল লাগত ওকে , তাই ও যখন প্রপোজ করেছিলো ,
তখন চিন্তা করার দরকারও ছিল না। প্রেমিক হিসেবে ১০০ তে ১০০ পাবে। সব ঠিক ঠাক চলত
যদি আমি বোকার মত দেশে না আসতাম , রনর সাথে দেখা না হত।
কেন এমনটি হল? এ কি করলাম আমি? কিকরে
নিজেকে হারিয়ে ফেললাম?
ফোন টা বেজেই যাচ্ছে । রন। গত দুদিন
ধরেই ফোন করছে। ফোন তো আরেকজনও করছে। রিয়াজ। আমি কোন মুখে রিয়াজের সামনে গিয়ে
দাঁড়াবো? ওর আমার প্রতি অটল বিশ্বাস , অগাধ ভালবাসা ... সবকিছু কে অপমান করেছি
আমি। নিজের ভেতর টা তন্ন তন্ন করে খুঁজলাম , না, এমন কিছু হয়নি আমার আর রণর মাঝে।
কিন্তু অপরাধ বোধ কেন কুরে কুরে খাচ্ছে আমায়?
-হ্যালো
- তিয়া? থ্যাংক গড । খুব ভয় পেয়ে
গিয়েছিলাম। তুই ফোন তুলছিলি না।
- কেন ফোন করেছিস ?
-তুই জানিস কেন করেছি।
-না না না...আমি জানি না, আমি জানতে
চাইনা । প্লীজ রণ প্লীজ। ফোন রাখ তুই। আমি চাইনা তোর সাথে কথা বলতে।
- আমি দেখা করতে চাই, এখুনি , প্লিয
তিয়া, এই একটি অনুরধ রাখ ।
-না রণ এ, হয় না।
-কেন তিয়া? প্লীজ তিয়া , একটিবার। আমার যে অনেক কিছু বলার
আছে তোকে । অনেক কিছুর হিসেব নিকেশ বাকি আমাদের মাঝে। ভাগ্য আমাদের এই জীবনের
বাঁকে এনে দাড় করিয়েছে, এভাবে তুই আমায় এড়িয়ে গিয়ে দুটো জীবন কে নষ্ট হতে দিতে
পারিস না।
- দুটো জীবন? রণ , এতটা স্বার্থপরের
মত কিভাবে কথা বলতে পারছিস তুই? এটা বাস্তব। কুছ কুছ হোতা হ্যাঁ এর গল্প না, বা
আর বস্তা পচা বলিউড ফিল্মের কাহিনী না। যেখানে নায়ক নায়িকা কে সুখে ঘর কন্না করতে
দেবার জন্য, দর্শক দের মনের ইচ্ছে পূরণ করার জন্য, শত
নৈতিক প্রশ্ন কে ধূলিসাৎ করে দিয়ে
শেষ পর্যন্ত হাসি মুখে আর কয়েকটা জীবনের ,
আর কয়েকটা নিষ্পাপ , সরল ভালবাসার বলিদান দেওয়া হয়। কিকরে ভুলে গেলি যে একটা মেয়ে
চোখ বন্ধ করে তোর উপর বিশ্বাস রেখে, তোকে ভালবেসে অপেক্ষায় আছে? ওর কি দোষ?
ফোনের ওপাশে পিনপতন নীরবতা । আমি কি
সফল হতে পারব শেষ পর্যন্ত?
রন(৫)
আমি তিয়া কে চাই । আমার অস্তিত্তের
প্রতিটি বিন্দু দিয়ে চাই । সেই অসম্পূর্ণ
সন্ধ্যাকে পূর্ণতা দিতে চাই । আমি চাই ওর হাত ধরে
মাইলের পর মাইল ধানক্ষেতের আল ধরে হেটে জেতে। আমি চাই ওর গোলাপের পাপড়ির
মতো ঠোঁটে আমার ভালবাসার পরশ এঁকে দিতে। কিন্তু তিয়া যা বলছে তার এক বর্ণ মিথ্যে নয়। নাতাশা জীবন দিয়ে আমায়
ভালবাসে । কি করে অস্বীকার করব এই ধ্রুব সত্য টা কে?
-
তিয়া আমি কি করব তিয়া? আমি যে... তোকে ......
-
ফিরে যা রণ । আমরা অনেক আগে থেকেই হয়তো ভালবাসতাম একে
অপর কে। কিন্তু অনেক দেরী হয়ে গেছে । জীবন আমাদের ফেলে অনেক এগিয়ে গিয়েছে। হয় তো
এই ছিল পরিণতি ।
-
একটা শেষ প্রশ্ন ছিল তিয়া।
-
কি?
-
তুইও কি রিয়াজের
সাথে এগিয়ে যাবি?
ফোনের ওপাশে
পিনপতন নিস্তব্ধতা।
তিয়া ফোন কেটে
দিয়েছে। আমি আবার চেষ্টা করলাম ...“the number you are
calling is currently switched off”
রণ ফিরে গেছে
নাতাশার কাছে। নিরাপদ জীবনের কাছে। তিয়া পারেনি রিয়াজের সাথে এগিয়ে জেতে। এটা ওর নির্বুদ্ধিতা না অক্ষমতা নিয়ে অনেক
মতবিরোধ হতে পারে। রিয়াজের একনিষ্ঠ ভালবাসা কে অপমান করার সাহস ওর হয়নি। রিয়াজ কে
হয়ত সব কিছু খুলে বললে হয়ত গ্লানি কিছুটা কমত। কিন্তু রিয়াজের চোখে বিশ্বাস
হারাবার বেদনার সাক্ষী ও হতে চায়নি। তিয়া
জানে না ওর সিধান্ত ঠিক ছিল না ভুল।
পাঠকদের কাছে প্রশ্ন রইল। তিয়া বা রণের
সিধান্ত “উচিত না অনুচিত” ?
-
-
Your style of story telling is flawless.
ReplyDeleteKeep writing nice stories.... Stories with 'happy ending' are the 'mind refreshing doses' for we readers.