১।
এক মাথা ঢেউ খেলানো চুল, লম্বাটে মুখ, ছোট্ট এক জোড়া গভীর চিন্তামগ্ন চোখ ,টিকালো নাকে আলো আধারির খেলা, পাতলা দুটি ঠোঁট ।
অনেকক্ষণ ধরেই ছবিটার দিকে এক দৃষ্টি তে তাকিয়ে আছে তমসা । অসাধারণ কিছু নয় ছবির চেহারাটা । একটু বেশী সময় নিয়ে তাকালে খুব সাবধানে মুখের খাঁজে লোকানো আবছা নিষ্ঠুরতা ভেসে ওঠে । নিষ্পাপ চোখের তারায় ক্রূর ঝিলিক। এগুলো গড়পড়তা মানুষের নজর এড়িয়ে যাবে। সাধারণ মানুষের জন্য চেহারাটা একটি অতি সহৃদয় মানুষের । । এই চেহারার প্রতিটি পরতের সাথে পরিচিত ও । বহুদিন ধরে, বহু বছর ধরে। মুখের মাংসপেশিতে জমে থাকা নিষ্ঠুরতার প্রতিটি স্তরের সাথে পরিচিত । মস্তিষ্কের প্রতিটি কোষে মৃদু আলোড়ন ছড়ায় । থেকে থেকে শিউরে ওঠে মাঝেমাঝেই। প্রচণ্ড ইচ্ছে হয় পালিয়ে যেতে চেহারা টা থেকে । পারেনা। কেমন একটা অদৃশ্য বাঁধনে বাঁধা পড়ে গেছে। পুরনো ব্যর্থতার পুনরাবৃত্তি হয়। পুরাতন ক্ষত থেকে আবার হয় রক্তক্ষরণ। তবুও কোন এক অমোঘ আকর্ষণে নির্নিমেষে তাকিয়েই থাকে ও।
ল্যাপটপ বন্ধ করে একপাশে সরিয়ে রাখে ।এক মিনিট, দু মিনিট । আরচখে একবার তাকায় বন্ধ ল্যাপটপ টার দিকে। নিজেকে শাসন করে। ঘড়ির কাটা ঘুরে চলে ...এক সেকন্দ দু সেকন্দ...অবশেষে হার মানে। মনিটর এ ছবিটা ভেসে উঠতেই সশব্দে নিজের গালে চড় মারল এবার । কোন ব্যথার অনুভূতি হয়না। আবার মারে। ক্রমাগত শপাটে মেরেই চলে। অবশেষে একসময় ক্লান্ত হয় । লালচে হয়ে যাওয়া আঙুলের প্রান্ত ছুঁয়ে জেতে থাকে মানুষটির চোখ , নাক, গাল, ঠোঁট , চিবুক ...
২।
“বিপ” হালকা চাপ দিতেই ইনবক্স এ বসে থাকা মেসেজ খুলে গেল।
“ লাঞ্চ করে নিও। লাভ ইয়উ”
ছোট্ট বার্তা । শেষের দুটো শব্দের দিকে চোখ বোলায় । ফোনের অপর প্রান্তে বসে থাকা মানুষটা অপেক্ষা করবে প্রতিউত্তরের । কি প্যাড এ চাপ দিয়ে লিখতে থাকে তমসা ।
“ ঠিক আছে” ।
সেন্ড ।
তিনটে শব্দের প্রতীক্ষায় কত প্রহর কেটে গেলো অরূপের । যদিও ওই তিনটি শব্দের অনুপস্থিতিতে কিছুই আটকে থাকেনি। প্রথমবার তমসার ডান হাত ধরে নিজের বুকের উপর যেদিন রেখেছিল, কাঁপা কাঁপা স্বরে উচ্চারণ করেছিল ভালবাসি , তমসা কিছুক্ষণ এক দৃষ্টি তে ছেয়েছিল । কি ছিল সেদিন ওই টানা দু চোখে? মাথা চেপে ধরে দুহাতে উত্তরের সন্ধানে । কিছুই মনে পরে না। কিছুই উদ্ধার হয়না সে চোখের ভাষার । মনে পরে শুধু দিনের পর দিন রাতের পর রাত অলীক কল্পনায় যে অধরে আকণ্ঠ ডুবে জাওয়ার স্বপ্ন দেখে দিন কাটাতে হয়েছিল তার অপ্রত্যাশিত স্পর্শ । তমসার ঠোঁট নিজের ঠোঁটের ওপর আবিষ্কার করে অভিভূত হয়ে পরেছিল। তমসা যে প্রতিউত্তর দেয়নি মনেই ছিলনা। গতানুগতিক ভাবে জীবন এগিয়ে গেছে দুজনের। ঘনটার পর ঘনটা কেটে যায় ফোনের দু প্রান্তে প্রেমিক প্রেমিকার মত ভবিষ্যতের পরিকল্পনায় । হাজার কথার ভিড়েও অরূপ খোঁজ পায়, কিছু একটা নেই। হাতড়ে বেড়ায় ... আচমকা বজ্রপাতের মতই উপলব্ধি... তমসা আজো বলেনি ...“ভালবাসি”।
৩।
জানালা দিয়ে প্লেনটাকে উড়ে যেতে দ্যাখে পিয়ুশ। দুহাত প্যান্ট এর দু পকেটে গোঁজা , ক্লান্ত দেহের ভারে ঈষৎ ন্যুজ মেরুদণ্ড , আঙুলের সমান প্লেনটা ছোট্ট বিন্দু হয়ে মেঘের মাঝে মিশে যেতেই ঘুরে দাড়ায় । প্রচুর কাজ জমে গেছে অফিসের । আজ শেষ করতেই হবে একে একে। প্লেন এর ল্যাজ এ কি যেন লেখা ছিল? মনে করতে পারে না। ফাইল এর অক্ষর গুলো অবোধ্য লাগছে। টাই এর বাঁধন সামান্য আলগা করে দিল। আশেপাশের কেউবিকেল গুলি সব একে একে খালি হয়ে যাচ্ছে । পিয়ুশের সামনে ফাইলের মিনি পর্বত ।
“ম্মম্মম, আজ কাজ না করলেই নয়? আমাকে যে কথা দিয়েছিলে ঘোরাবে”? কানের লতিতে তমসার উষ্ণ পেলব ওষ্ঠের স্পর্শ । আবেশে চোখ বুজে আসে পিয়ুশের । তমসার দুহাতের নরম বেষ্টনীতে জড়িয়ে থাকা গলাকে মুক্ত করে হাত বাড়িয়ে পেছন থেকে টেনে নিয়ে আসতে চেষ্টা করে ওর মুখ।
“ আই পিয়ুসদা, এই দাদা, একি পড়ে গেলেন কিকরে হতাথ? লাগেনি তো”?
“ইশ ইশ, উঠুন উঠুন”।
দিশেহারা ভাবে চারদিকে তাকায় , চেয়ার থেকে পরে গেছে পিয়ুশ। তমসা ? নেই, কেউ নেই।
কেঁদে ফেলেছিল তমসা ফোনে হু হু করে।
“এমন কেনও করছ? প্লীজ , আমি কালই চলে যাব , একটিবার দেখা কর” । মিনতিভরা কণ্ঠস্বর ।নিজেকে আবেগপ্রবণ হওয়া থেকে আটকেছে পিয়ুশ। শক্ত মুখে না বলেছে। আরও একবার ভুল করতে পারবে না সে। অসম্ভব প্রেমের কষ্ট সে জানে। আরও একবার অসম্ভব কে তাড়া করে প্রেমের খোঁজ করার বিলাসিতা দেখাতে পারবে না সে।
তমসার সাথে কাটানো প্রতিটি মুহূর্তের স্মৃতি এখনো তাড়িয়ে বেড়ায় । তমসার পাখির বুকের মত নরম শরীর , মিশে যেত ওর বুকে, দুহাতে শক্ত ভাবে আঁকড়ে থাকতো , যেন এখুনি পালিয়ে যাবে পিয়ুশ। নিজের অনুভূতির মুখোমুখি হতেই ভয় পেল প্রথমবার। দূর দেশের অতিথি পাখি তমসা । শীত শেসেই ফিরে যাবে নিজের আস্তানায়। ফেলে রেখে যাবে শুধু কিছু স্মৃতি । তীব্র আশ্লেষে তমসার অধরে বিলীন হতে হতেও নিজের অস্তিত্বের প্রতিটি বিন্দুকে তিরস্কার করেছে।
সফল হয়েছিলো । তমসার আবেগের কাছে হার মানেনি। না হার মেনেছে নিজের আবেগের কাছে। অস্বীকার করেছে বারবার নিজের অনুভূতিকে। হ্যাঁ , সে ভালবাসে ।শরীরের প্রতিটি কোষে সুতীব্র হাহাকার ওঠে , তারা চীৎকার করে, আবেদন জানায়। কিন্তু মস্তিষ্ক পর্যন্ত সে আবেদন প্রসারিত হয়না। পিয়ুশ চেতনাহীন , মুক, বধির।
“তুমি এত কষ্ট কেন দাও আমায়”?
কি বলবে পিয়ুশ? কষ্ট ছাড়া যে আর কিছুই দেওয়ার নেই।
৪।
পিঙ্ক রঙের ১০০ টা গোলাপের তোরা হাতে নিয়ে তমসা বসে আছে। সামনে হাঁটু গেড়ে অরূপ।
হাঁটুতে ভর দিয়ে তমসার সমান্তরালে এসে হালকা চুমু এঁকে দিল ঠোঁটে ।
“হ্যাপি আনিভারসারি সুইটু । লাভ ইয়উ আমার সোনা”।
“সেম টু ইয়উ হানি”। তমসা হাসি মুখে চুমু ফিরিয়ে দিতে দিতে বলল।
অরূপ প্রচণ্ড আশা করেছিল তিনটে শব্দ শোণার । বিষণ্ণ দৃষ্টিতে চোখ রাখে তমসার চোখে ।
“ কি হয়েছে অরূপ? এমন কেন দেখাচ্ছে তোমায়? আজ অফিসে কিছু হয়েছে বুঝি”?
তমসাকে সমস্ত শক্তি দিয়ে ভীষণভাবে ঝাঁকাতে ইছহে হয় অরূপের । ইচ্ছে হয়, চীৎকার করে বলতে, তুমি কি অন্ধ তমসা ? তুমি কি মানসিক ভাবে পঙ্গু? তুমি কি কিছুই বোঝো না? তিলে তিলে কিকরে আমার মৃত্যু হচ্ছে প্রতিদিন? আমি কি এতটাই অযোগ্য তোমার ভালবাসার যে তোমার মুখ দিয়ে আজো ভালবাসি শব্দটা উচ্চারিত হল না?
“আই লাভ ইয়ু ড্যাম ইট । I so fucking love you.”
বিকারগ্রস্ত রোগীর মত চীৎকার করেই যাচ্ছে অরূপ । দিক্বিদিক শূন্য হয়ে কখন যে নিজের স্বগতোক্তি জিহ্বার ফাঁক দিয়ে ভাষায় পরিণত হয়েছে জানেনা । তমসা এখনো সোফায় বসা , চিত্রার্পিত । শুধু নীরবে ঝরে যাচ্ছে অশ্রুজল ।
ঘরের এক কোণ থেকে ছুটে এসে তমসার সামনে হাঁটু ভেঙে পরে গেল। তমসার দুপা হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে উরুর উপর মাথা রেখে হু হু করে কেঁদে উঠলো ।
“একটিবার তম, শুধু একটিবার বল ভালবাসি , আর কিচ্ছু চাইনা , এ জগতের সব সুখ তোমার পায়ে সমর্পণ করবো , সুধু একটিবার বল, ভালবাসি”।
তমসার অন্তরাত্মা প্রবলভাবে কেঁপে ওঠে । অনেক পুরনো ঘটনা মনে পরে যায়...
“ একটিবার বল পিয়ুশ। আমি জানি তুমিও আমায় ভালোবাসো । তবুও আমি তোমার মুখ থেকে শুনতে চাই । প্লীজ পিয়ুশ”।
এক মাথা ঢেউ খেলানো চুল, লম্বাটে মুখ, ছোট্ট এক জোড়া গভীর চিন্তামগ্ন চোখ ,টিকালো নাকে আলো আধারির খেলা, পাতলা দুটি ঠোঁট...নীরব , নিথর।
অন্ধকার ঘরে তমসা আর অরূপ কেঁদেই চলে ....
No comments:
Post a Comment